রবিউল ইসলাম মিনাল,রাজশাহী প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত এলাকার একশ্রেণীর গরু খামার মালিকের বিরুদ্ধে চোরাচালান ও মাদক কানেকশনের গুঞ্জন উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমান্ত এলাকার চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। তারা নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারসহ রাজাবাড়ি এলাকার কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন খমার বলে আলোচনা রয়েছে। আলোচনার শীর্ষে রয়েছে, তরুণ বয়সী একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি যাদের রাজনৈতিক জীবনটায় পালা বদলের। যারা এক সময় পদ্মা নদীতে মাছ শিকার ও অন্যর জমিতে কামলা দিয়ে জীবীকা নির্বাহ করেছে।
অথচ গোদাগাড়ীতে মাদক চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসা ও চোরাপথে ভারত থেকে প্রসাধনী সামগ্রীর এনে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে তারা। এদের আয়ের উৎস্য কি তার অনুসন্ধান সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা বলছে, কৃষকেরা নিজ হাতে গরু লালনপালন করেও লোকসানে পুঁজি হারাচ্ছে। অথচ একশ্রেণীর গরু খামারি জনবল নিয়োগ দিয়ে গরু লালনপালন করে বিপুল অঙ্কের টাকা মুনাফা করছে-এর হেতু কি ?
সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মুখে আলোচনা রয়েছে এরা বিশেষ কায়দায় গরুর পেটে ইয়াবা-হেরোইন দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়ছে।
এদিকে সরকারি খামার কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রায় ১৩২ একরের এলাকাজুড়ে খামারের প্রায় ১৮টি স্থানে ইটের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে অনায়াসে মাদক নিয়ে ঢুকছে কারবারিরা। হাজার কোটি টাকার সম্পদ মাত্র চারজন মিলে পাহারা দেয়ায় সুযোগ নিচ্ছে তারা। দিনে কোনোভাবে সামাল দিতে পারলেও রাতের অন্ধকারে মাদক চালান করছে
মাদক কারবারিরা।
সূত্র জানা যায় , খামারের উত্তরে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক, দক্ষিণে পদ্মা নদী। পদ্মা পেরোলেই ভারত সীমান্ত। পূর্ব দিকে ১০০ মিটার দূরে রাজাবাড়ীহাট।ফলে খামারের বিশাল আয়তনের এলাকা মাদক কারাবারিদের জন্য অনন্য রুট হয়ে উঠেছে।
কোনোমতে ভারত সীমান্ত থেকে মাদকের চালান খামারের মধ্যে ঢুকলেই পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাশের বাজার অথবা গাড়িযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী শহরে। খামার কর্তৃপক্ষ জানায়, সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার আগেই মাদক সেবন ও বিক্রি শুরু হয়। চোখের সামনে মাদকের চালান দেখলেও নিরুপায় তারা। কারণ খামার থেকে গোদাগাড়ী মডেল থানা প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। পাশের প্রেমতলি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দূরত্বও প্রায় ১২ কিলোমিটার। ফলে দ্রুত পালিয়ে যায় চোরাকারবারিরা।
সম্প্রতি গত শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়, রাজশাহী দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারের দেয়ালঘেঁষা বেশ কয়েকটি টিনের খুপরি ঘর। দেয়ালের কাছে মাটি দিয়ে চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া পুরো সীমানাপ্রাচীরের প্রায় ১৮টি স্থানের ইট খুলে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এসব ফাকা দিয়ে বহিরাগতরা অবাধে প্রবেশ করছে চারণভূমিতে। নিরুপায় হয়ে বাঁশ ও বরইয়ের ডাল দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। তারপরও খামারের চাষ করা ঘাস কেটে ফেলা হচ্ছে। চুরি হচ্ছে খামারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও জিনিসপত্র। এ খামারে সম্পদের পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা কিন্তু পাহারাদার মাত্র একজন। তার সঙ্গে দৈনিক মজুরিভিত্তিক তিন শ্রমিক দিয়ে খামারের একটি অংশ পাহারা দেয়া গেলেও বিশাল চারণভূমি রয়ে গেছে অরক্ষিত।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, বিশাল খামারের পাশে পদ্মা। আর পদ্মার ওপারে ভারতীয় সীমান্ত হওয়ায় রাতের বেলা খামারে সেভাবে পাহারা বসানো যাচ্ছে না। এরই সুযোগ নিচ্ছে মাদক চোরাচালানিসহ অপরাধীরা। এক্ষেত্রে খামারের জনবল বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মাদক চালান নিয়ন্ত্রণ করতে ও খামারের নিরাপত্তায় জনবল নিয়োগের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে অনুরোধ জানিয়েছে তারা। একই সঙ্গে ক্যাম্পসহ সশস্ত্র আনসার সদস্য মোতায়েনের আবেদনও পাঠানো হয়েছে দপ্তরে। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর এ আবেদন পাঠান খামার ব্যবস্থাপক মহাম্মদ আব্দুল হামিদ। এতে উল্লেখ করা হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতার প্রায় ২০ লাখ টাকা আসে খামারে। দুধ, ঘাস, গোবর ও বাতিলকৃত গবাদিপশু বিক্রির প্রায় ২৫ লাখ টাকা জমা হয় ট্রেজারিতে। পুরো আর্থিক লেনদেনে নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন খামার সংশ্লিষ্টরা।
তাছাড়া দাপ্তরিক কাজ ও গোখাদ্য টেন্ডারসহ বিভিন্ন নিলাম হয় এখানে। ওই সময় বহিরাগতরা খামার চত্বরে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতে হুমকিতে পড়েন খামারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। থানা ও ফাঁড়ি দূরে হওয়ায় কোনো ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছার আগেই অপরাধীরা বেরিয়ে যায়। এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। থানায় অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মেলে না।
খামারের উপপরিচালক ডা. আতিকুর রহমান জানান, বর্তমানে তিনজন কর্মকর্তা, ২৫ জন কর্মচারী ও ২৫ জন দৈনিক হাজিরাভিত্তিক শ্রমিক মিলিয়ে খামারে কর্মরত ৫৩ জন। এর মধ্যে স্থায়ী বা রাজস্ব খাতে ৪৯ পদের বিপরীতে কর্মরত ২৫ জন। এ খাতের বিভিন্ন ক্যাটেগরির ২৪টি পদ শূন্য। দীর্ঘদিন নতুন স্থায়ী জনবল নিয়োগ নেই। দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২৯ পদের বিপরীতে কর্মরত ২৫ জন। এ খাতের পদ খালি তিনটি। ১৯৯৬ সালের পর থেকে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগও বন্ধ। মাঝে আধুনিকীকরণ প্রকল্প থেকে ছয়জন এবং দ্বিতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৩৩ জন জনবল এসেছে খামারে। যদিও এখানো অস্থায়ী এ রাজস্ব খাতের পদ খালি রয়েছে ৪৮টি। খামারের দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে ১৯৮৪ সালে যোগ দেন আসলাম উদ্দিন। তিনি জানান, প্রায় ১৬ বছর ধরে তিনি খামারের স্থায়ী পাহারাদার। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন পাহারা দেন। আরেকজন পাহারা দেন বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। বাকি দুজন রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পাহারায় থাকেন। দিনের বেলা বাইসাইকেলে পুরো এলাকায় নজরদারি করা যায়, কিন্তু রাতে হেঁটেই পাহারা দিতে হয়। এটি খুবই কষ্টসাধ্য। মাঝে মধ্যে পাহারাদারের দায়িত্ব পালন করেন আরেক দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক রবীন্দ্রনাথ সরকার। তবে তারা বয়স্ক ও সংখ্যায় অল্প হওয়ায় চোখের সামনে কী ঘটছে তার বাইরে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন না।
জানা যায়, রাজশাহী দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামার প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৬৮ সালে। তখন প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল এস্টাবলিস্টমেন্ট অব ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল ব্রিডিং ফার্ম। ১৯৮৪ সালে খামারটি বর্তমান নাম পায়। ওই সময় খামারে পাহারাদারের পদ ছিল তিনটি। ১৯৯২ সালে পাহারাদার ইসাহাক আলী খান মারা যান। তখন পদ নেমে আসে দুটিতে। এরপর ২০১৪ সালে অবসরে যান আরেক পাহারাদার লুৎফর রহমান। সেই পদে নতুন করে আর লোকবল নিয়োগ হয়নি। ফলে স্থায়ী পাহারাদার নেমে আসে একজনে। দুটি প্রকল্প রাজস্ব খাতে গেলেও সেখান থেকে পাহারাদার পদে জনবল পায়নি রাজশাহীর গো-খামার। ফলে দৈনিক মজুরিভিত্তিক তিনজন শ্রমিক যুক্ত রয়েছে খামার পাহারায়। যদিও পালাক্রমে খামার পাহারায় অন্তত নয়জন লোক দরকার।
কথা হয় দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, খামারে স্থায়ী পাহারাদারের পদ মাত্র দুটি। একজন অবসরে গেছেন। রয়েছেন আরেকজন। তার সঙ্গে তিনজন দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক পাহারাদারের কাজ করেন। তারা কেবল খামার চত্বর পাহারা দেন। আগে চারণভূমিতেও দুজন পাহারাদার ছিলেন। লোকবল সংকট থাকায় এখন নেই।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী দুগ্ধ ও গবাদি উন্নয়ন খামারের উপ-পরিচালক ডা. আতিকুর রহমান বলেন, গরুর খামার অর্থাৎ মূল কাঠামো এক জায়গায় এবং গো-চারণভূমি রাস্তার ওপাশে। সীমানাপ্রাচীরের প্রায় ১৮টি স্থানের ইট খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। আমি নিজে রাতে টহল দিই। সীমিত জনবল দিয়ে খামার ও ঘাসের খেত পাহারা দেয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। ভেঙে ফেলা দেয়াল বেড়া দিয়ে আটকে রেখেছি। সন্ধ্যা নামার পরপর মাদকের হাট বসে খামারের চারদিকে। তাদের হাতে অস্ত্র থাকে। আমরা নিরুপায়। একদিকে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়। ঘাস চুরি হয়, শেয়ালে গরুর বাছুরকে আক্রমণ করে, জিনিসপত্র চুরি হয়। এছাড়া ফোকর দিয়ে বহিরাগতরা অবাধে প্রবেশ করে চারণভূমিতে। এসব অপরাধ আগের চেয়ে কিছুটা কমলে জনবল সংকটে তা নির্মূল করা যায়নি। তিনি বলেন, জনবল নিয়োগসহ আনসার ক্যাম্প স্থাপন করা গেলে অনেকাংশে খামারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। সিসিটিভি ক্যামেরা লাগালেও নিরাপত্তা নেই। কারণ তারা যে ক্যামেরা চুরি করবে না তার গ্যরান্টি নেই।