গোলজার রহমান,ধামইরহাট প্রতিনিধিঃ
নওগাঁর ধামইরহাটে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পিস কমিটির সদস্য ওসমান হাজীর নির্দেশে ১৪ জন গিরস্থ ও শ্রমিক গণহত্যার স্বীকার হন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে সহযোগিতা করার অপরাধে শ্রাবন মাসের ৬ তারিখ দুপুর একটায় ২০ জন মুক্তিকামী জনতাকে কুলফৎপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে এনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন শহীদ হন এবং ৬ জন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। এঁদের মধ্যে অনেকেই মাঠে হাল চাষের সময় ও নিজ বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হয়।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে সময়ের আলোকে বাকরুদ্ধ কন্ঠে এমনই নৃশংস গণহত্যার বর্ণনা দেন প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মান্নান। বড় ভাইয়ের সঙ্গে তাঁকেও পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা দুই হাত ও চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। এবং ওই দিন বুলেটের আঘাতে বড় ভাই মতিবুল শহীদ হলে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবারদের স্বীকৃতি না পাওয়া এবং ভাই হারানো কষ্টের সেই ক্ষত আজও বহন করে চলেছেন আব্দুল মান্নান ও তাঁর পরিবার।
তিনি এও বলেন, পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গুলি করার সময় তিনিসহ আরও ৬ জন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এতে ১৪ জন শহীদ হন এবং বাকিদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা তার জন্য পাক-বাহিনীর সদস্যরা রাইফেলের বাঁট ও পা দিয়ে খুঁচে সকলের শরীরে আঘাত করেন। এসময় বাকি সদস্যরা মৃত্যুর ভয়ে পাক সেনাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান। এরপর পাক বাহিনী ওই ৬ জনকে রশি দিয়ে বেঁধে পার্শ্ববর্তী ফার্সিপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যান। ওদের মধ্যে আব্দুল মান্নানের নামের সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর কমান্ডারের নামের মিল থাকায় ওইযাত্রায় তিনি প্রাণে রক্ষা পেলেও ওইদিন বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা আজও তাঁর কাছে অজানা রয়ে গেছে।
গণহত্যার শিকার বীর শহীদেরা হলেন- উপজেলার উমার ইউনিয়নের কুলফৎপুর এলাকার মৃত বজির উদ্দীনের ছেলে শহীদ আমজাদ হোসেন, মৃত কফিল উদ্দিন মন্ডলের ছেলে শহীদ চান মদ্দীন মন্ডল, মৃত ইছরত আলী দেওয়ানের ছেলে শহীদ কছি মদ্দীন মন্ডল, সুবার উদ্দীন মন্ডলের ছেলে শহীদ ছয়েফ উদ্দীন, আবেদ আলী মন্ডলের ছেলে শহীদ আবতাব উদ্দীন, মৃত আবেদ আলী মন্ডলের ছেলে শহীদ তায়েজ উদ্দীন, মৃত সিরাজ উদ্দীনের ছেলে শহীদ মতিবুল হোসেন, টুটি কাটা এলাকার মৃত ছবির উদ্দীনের ছেলে শহীদ আব্বাছ আলী, মৃত শরিফ উদ্দীনের ছেলে শহীদ আাবেদ আলী।
এছাড়াও কৈগ্রাম এলাকার মৃত ছালে মদ্দীনের ছেলে শহীদ রহিম উদ্দীন, মৃত মহির উদ্দীনের ছেলে ফয়জুল ইসলাম, মৃত কিমির উদ্দীন মন্ডলের ছেলে শহীদ তজির উদ্দীন মন্ডল, মৃত সহিদ তজীর উদ্দীন মন্ডলের ছেলে শহীদ তমিজ উদ্দিন (বিজু), এবং দাড়াবাতা এলাকার মৃত রহিম উদ্দীনের ছেলে শহীদ অবির উদ্দীন।
সরোজমিনে উপজেলার উমার ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ড কুলফৎপুর এলাকার দেখা যায়, ওই ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সৌজন্যে গণহত্যার শিকার ১৪ জন শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও অজ্ঞাত কারণে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নজরদারির অভাবে গণ কবরের চারপাশ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকায় সেখানে গরু, ছাগলের বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। একারণে শহীদ পরিবার ও স্থানীয়দের মধ্যে একরকম চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও গণহত্যার শিকার পরিবারদের খোঁজ রাখেনি কেউ। বছরের পর বছর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেও সংরক্ষণ করা হয়নি গণ কবরের চারপাশ। সরকারিভাবে শহীদ পরিবারদের স্বীকৃতিও মেলেনি তাঁদের। পাননি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ কোন অনুদান। এমন বীভৎস স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে মানাবেতর জীবন যাপন করছেন শহীদ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া আব্দুল মান্নানের স্ত্রী আনজুয়ারা ও শহীদ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আক্ষেপ করে বলেন, ‘পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মাঠ থেকে গ্রামের গিরস্থদের (কৃষক) ধরে এনে হত্যা করেন। এদের মধ্যে কেউ বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। অথচ গণকবরটিকে ঘিরে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে সেখানে বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করা হয়। এমন অবস্থায় গণহত্যার স্বীকার বীর শহীদদের প্রতি অসম্মান ও ইতিহাস বিকৃতের গুরুতর অভিযোগ এনে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তাঁরা।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজাহার আলী সময়ের আলোকে জানান, ‘উপজেলায় বুদ্ধিজীবী হত্যার সুনির্দিষ্ট তেমন কোন তথ্য না থাকায় প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর কুলফৎপুর গণ কবরে গণহত্যার শীকার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করা হয়।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইএনও আসমা খাতুন বলেন, গণ কবরে বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপনের বিষয়ে মিটিংয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু অনেক আগে থেকে সেখানে বুদ্ধিজীবী দিবস উদযাপন করা হয় বিধায় এ বিষয়ে বীর মুক্তিযুদ্ধোসহ সংশ্লিষ্টদের কোন সহযোগিতা পাননি তিনি। তবে বিষয়টি দেখা হবে বলে সময়ের আলোকে আশ্বস্ত করেন তিনি।’