অ্যাডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকতঃ
এথিকস বা নৈতিকতা হল এমন কিছু অলিখিত (কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিখিত) নীতিমালা যা সকল আইনজীবীর অবশ্য থাকা উচিত। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী (ডিফেন্স ল’য়ার),সরকারী পক্ষের কৌশলী(প্রসিকিউটর)‘র জন্য পেশাগত জীবনে অবশ্য পালনীয় নীতিমালাসমূহ বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কমন ল’ ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহে বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন বিচারিক নজির,সংবিধি অথবা নিয়ন্ত্রণকারী আইনজীবী সংগঠন (বার কাউন্সিল/অ্যাসোশিয়েশন)কর্তৃক নির্ধারিত/প্রণীতআচরণবিধির মাধ্যমে এসকল নীতিমালাসমূহের উৎপত্তি হয়েছে।এসকল নীতিমালা পালনে ব্যর্থতার জন্য অনেক সময় একজন আইনজীবী ভৎসনা,বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। তাই একজন আইনজীবীর পেশাগত জীবনে এসকল নীতিমালা অবশ্য মেনে চলা নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য।
অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী (ডিফেন্স ল’য়ার)’র কর্তব্য:
বিচারক ও সরকারি কৌশলীর সাথে মামলা সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনায় অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর সর্বদা পেশাগত আচরণ করা উচিত। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে সর্বদা কার্যকর প্রতিনিধিত্ব করা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের নৈতিক দায়িত্ব। অসাধু বা অনৈতিক আচরণ একজন ডিফেন্স ল’য়ারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনাম নষ্ট করতে পারে।এমনকি যেহেতু একজন ডিফেন্স ল’য়ারঅভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে,তাই তার অসাধু বা অনৈতিক আচরণ অভিযুক্ত ব্যক্তিরও বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনাম নষ্ট করতে পারে।
মক্কেলের প্রতি কর্তব্য:
মক্কেলের প্রতি একজন ডিফেন্স ল’য়ারের অনেক মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আইনগত পরামর্শদাতা হিসেবে একজন ডিফেন্স ল’য়ারের অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কার্যকর ও মানসম্মত প্রতিনিধিত্ব করা নৈতিক দায়িত্ব। অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে যৌথভাবে মামলা পরিচালনার সময় একজন ডিফেন্স ল’য়ারের সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত এড়িয়ে চলা নৈতিক দায়িত্ব। যুক্তিসংগত দ্রুততা ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে মামলা পরিচালনা করা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের নৈতিক দায়িত্ব।মক্কেলের সাথে সম্পাদিত সকল প্রকার যোগাযোগের গোপনীয়তা বজায় রাখা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের নৈতিক দায়িত্ব। মামলার প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহ সম্পর্কে যত দ্রুত সম্ভব তথ্যানুসন্ধান পূর্বক প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে তা মামলা পরিচালনায় ব্যবহার করা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের নৈতিক দায়িত্ব।
আদালতের প্রতি কর্তব্য:
নৈতিক ও পেশাগত আচরণের দ্বারা সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আদালতের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের কর্তব্য। একজন ডিফেন্স ল’য়ার কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতের সামনে ভুল তথ্য বা আইনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করবেন না। উদাহরণ স্বরূপ,যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি ডিফেন্স ল’য়ারের নিকট তার কৃত অপরাধের কথা সেচ্ছায় স্বীকার করে,তবে আদালতের সামনে অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত অপরাধ সংঘঠন করেনি মর্মে জবানবন্দী প্রদানে একজন ডিফেন্স ল’য়ার কখনো পরামর্শ দিবেন না। মামলা পরিচালনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির অনৈতিক ও অবৈধ নির্দেশনা অনুসরণ করা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের জন্য অবশ্য অনুচিত। প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিসমূহ যা সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুকূলে যায়,কিন্তু সরকারী পক্ষের আইনজীবী আদালতে উত্থাপন করেনি,সেসব আইন ও বিধিসমূহ খুঁজে বের করে আদালতে উত্থাপন করা একজন ডিফেন্স ল’য়ারের অবশ্য দায়িত্ব। একজন ডিফেন্স ল’য়ার অভিযুক্ত ব্যক্তি ও মামলা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান স্বার্থের দ্বন্দ্ব অবশ্য এড়িয়ে চলবেন। ফৌজদারী বিচার প্রশাসনের উন্নয়ন ও পুনর্গঠন এবং মূল আইন (সাবস্টান্টিভ ল’)ও পদ্ধতিগত(প্রসিডিউরাল ল’) আইনে যদি কোন অপর্যাপ্ততা থেকে থাকে তবে তা খুঁজে বের করে নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া একজন ডিফেন্সল’য়ায়ের নৈতিক দায়িত্ব।
রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর)’র কর্তব্য:
১৯ শতকের শুরুর দিকে অধিকাংশ মামলা অভিযোগকারী (ভিকটিম) ব্যক্তিগতভাবে নিজে পরিচালনা করতেন। সময়ের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর) অভিযোগকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে শুরু করে। বর্তমানে রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর) রাষ্ট্র ও ভিকটিম উভয়ের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ফৌজদারী মামলার কার্যকর পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর) মুখ্য ভূমিকা রাখে। কারণ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগসমূহ প্রমাণে তিনি কার্যকর সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। যদি অভিযোগকারী কর্তৃক আনীত অপরাধসমূহ অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পাদন করেছে মর্মে বিশ্বাস করার সম্ভাব্য যথেষ্ট কারণ থাকে, তবে একজন রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর)’র উক্ত মামলা পরিচালনা করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে মামলাটি পরিচালনা না করে বাতিলের জন্য পরামর্শ দেওয়া তার নৈতিক দায়িত্ব। বিচারের সময় অবৈধভাবে প্রাপ্ত সাক্ষ্যসমূহ ব্যবহার করা রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর)’র কোনভাবে উচিত নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ সংগঠন করেনি মর্মে কোন সাক্ষ্য বা প্রমাণাদি পেলে সে তথ্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জানানো রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর)’র নৈতিক দায়িত্ব। মামলা বিচারের পূর্বে,বিচার চলাকালীন বা বিচার পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র পক্ষের কৌশলী (প্রসিকিউটর)’র অযৌক্তিকভাবে মন্তব্য যেমন: ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতাকে হেয় করে এমন কোন মন্তব্য; বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ বা অন্য কোন কারণে পক্ষপাতিত্বমূলক মন্তব্য; প্রতিহিংসা বা সহানুভুতিশীল মন্তব্য; সাক্ষ্য থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এমন খারাপ কাজ সম্পর্কে মন্তব্য; জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির নিশ্চুপ থাকার অধিকার প্রয়োগ সম্পর্কে মন্তব্য ইত্যাদি করা থেকে বিরত থাকা উচিত। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় আমাদের দেশের অধিকাংশ আইনজীবী মক্কেলের প্রতি তাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্বও কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। যদিওবা কিছু কিছু আইনজীবী তা সম্পর্কে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল, কিন্তু সিনিয়র, জুনিয়র, খ্যাতিমান,অখ্যাত নির্বিশেষে অধিকাংশ আইনজীবীর সেসব নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য পালনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। ফলে মক্কেলরা অনেক সময় হয়রানীর শিকার হয়,যা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাই বিচার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে একজন আইনজীবীর মক্কেলের প্রতি তাদেঞর নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা উচিত।
লেখক: তরুণ ও উদীয়মান মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; ইমেল: saikotbihr@gmail.com, মোবাইলঃ +৮৮০১৭২০৩০৮০৮০