গোলজার রহমান,ধামইরহাট প্রতিনিধিঃ
নওগাঁর ধামইরহাটে উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার উত্তরে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আলতাদিঘীকে কেন্দ্র করে দিঘীর পূর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে শালবন। বনের উত্তরে তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা ভারতীয় সীমান্ত। মাঝখানে রয়েছে ইতিহাস সমৃদ্ধ এক সুবিস্তৃত আলতাদিঘী। বর্তমানে তা আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত।
আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানকে ঘিরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দা ও ঘুরতে আসা পর্যটকরা অভিযোগ করে বলেন, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এবং বন বিভাগের অসাধু কিছু অফিসার ও কর্মচারীদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে দুর্বৃত্তরা রাতের আঁধারে শালগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে উজাড় করেছে বন।
সোমবার (৩ জুন) দুপুরে সরজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আলতা দিঘীর পশ্চিম পারসহ বনের ভেতরের বিভিন্ন অংশে শতাধিকেরও বেশি শাল, ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের গোরা ও এর অংশবিশেষ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই শাল গাছের অর্ধেক, আবার কেউ কেউ গোড়া পর্যন্ত কেটে নিয়ে গেছে। এতে করে বনের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে অনেকটাই ফাঁকা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এসব ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে ২০১৪-১৫ সালে অপরিকল্পিতভাবে কয়েক লাখ বেতের গাছ রোপন করা হয়। এসব বেতগাছের কারণে ঘন জঙ্গল হওয়ায় শাল গাছের বংশবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে করে জীব বৈচিত্র হুমকির মধ্যে পড়েছে।
অন্যদিকে দফায় দফায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আলতাদিঘীর পশ্চিম ও দক্ষিণ পারসহ বনের ভেতরে বিভিন্ন অংশে বেতের গাছসহ প্রায় অর্ধ শতাধিকেরও বেশি শাল গাছ পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ‘এটি কি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা এনিয়ে সন্দেহের ডালপালা মেলতে শুরু করেছে স্থানীয়দের বক্তব্যে। তবে এ বিষয়ে তারা বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পুনঃ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
অগ্নিকান্ডের বিষয়ে বনবিট অফিসার আনিসুর রহমান জানান, ‘মাদক সেবীদের ফেলে দেওয়া বিড়ি সিগারেটের আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, আলতাদিঘী পুনঃখনন ও দিঘীরপাড় সংস্কারের জন্য ১৯৯১-৯২, ১৯৯২-৯৩, ২০০৭-২০০৮ সালে বনায়নের আওতায় ১৫টি লটের মধ্য দিয়ে ৩৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ টাকায় দিঘীর দুই পাড় ঘেষে বেড়ে ওঠা ৪৪৬টি আকাশমনি ও ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে।
বন কর্তৃপক্ষ জানায়, উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বন ঘেঁষে দীঘির পাশ দিয়ে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস, পর্যটকদের সুবিধার্থে রেস্টহাউস, পিকনিক কর্নার, পার্ক, টয়লেটসহ বেশ কিছু স্থাপনা তৈরির প্রায় ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে তৈরি হচ্ছে প্রায় ১৭০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ৬শ ৪৯ পয়েন্ট ৫৭ লাখ টাকা ব্যায়ে বন অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘আলতাদিঘী পুনঃখননের মধ্য দিয়ে আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের জীব বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পে দিঘীটি খনন করার পর দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জলহীন নিথর দেহের মতো পড়ে আছে আলতাদিঘী। এ কারণে শীত মৌসুমেও দেখা মেলেনি অতিথি পাখিদের। এতে করে পর্যটক বিমুখ হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ যেমন হুমকির মুখে পড়েছে ঠিক তেমনি দিঘীর সৌন্দর্য পুরোটাই বিলুপ্ত হওয়ার কারণে সম্ভবনাময় এই পর্যটন শিল্পটি হুমকির মুখে পড়েছে।
অথচ কয়েক বছর আগে প্রাচীন ইতিহাসের নিদর্শন আলতাদিঘীর সচ্ছ পানিতে ফুটে থাকা হাজারো পদ্মফুলের ডালে ও পাতায় অতিথি পাখিরা এসে দিঘীর নির্মল পানিতে দাপিয়ে বেড়াতো। শীতের সময় ডাহুক, বালি হাঁস, পানকৌড়ির কলকাকলি আর তাদের চঞ্চল ওড়াউড়িতে মুগ্ধ হতো নানান বয়সের মানুষের হৃদয়। ভ্রমণ পিপাসুরা মুগ্ধ হয়ে পরিবার নিয়ে ঘরে ফিরতো।
ধামইরহাট বনবিট সূত্রে জানা গেছে, পাইকবান্দা রেঞ্জের ধামইরহাট বিটে অবস্থিত আলতাদিঘী শালবন। উপজেলার ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে দিঘীটি অন্যতম। শালবনসহ ৬শ ৫২ দশমিক ৩৭ একরের মধ্যে মূল দিঘীটির আয়তন প্রায় ৪৩ একর। ধারণা করা হয় পাল আমলে প্রজাস সাধারণত পানির চাহিদা মেটাতে রানীর নির্দেশে আলতাদিঘী খনন করা হয়েছিল। এরপর থেকে রাজা ও রানীর রূপকথা এখনও প্রচলিত আছে এলাকার প্রবীণ ও শিশুদের মুখে মুখে। প্রাচীন দিঘী গুলোর মধ্যে এটাই সর্ববৃহৎ ও সচল দিঘী। ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর শালবনসহ আলতাদিঘীকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।